বিশেষ প্রতিবেদক
সিলেটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতার উপর হামলার ঘটনার ৫ মামলার অন্যতম আসামি ডেভিল জাকারিয়া আহমদকে গ্রেফতারের মাত্র ১২ ঘন্টার ব্যবধানে জামিনের ঘটনায় সিলেটজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সিলেট বিএনপি এবং সিলেট জাতীয়তাবাদী আইনজীবিদের নিয়ে নেটিজেনেরা বিরুপ মন্তব্য করছেন। বিষয়টি নিয়ে সরগরম আদালত পাড়াও। ডেভিল জাকারিয়ার মুক্তি এখন ‘টক অব দ্য টাউন’। এঘটনায় সিলেট জেলা শ্রমিকদল থেকে শোকজ করা হয়েছে ক’জনকে এবং গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সিলেট বিএনপি।
সিলেট জেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক ও সাবেক জেলা ছাত্রদলের সভাপতি এ্যাডভোকেট সাঈদ আহমদের সহযোগীতায় বিএনপি মতাদর্শের এ্যাডভোকেট সাজ্জাদের ওকালতনামায় জামিন পান ৬টি মামলার আসামি, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার উপর হামলাকারি শ্রমিক লীগ নেতা জাকারিয়া আহমদ। মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) এ্যাডভোকেট সাঈদ এসময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তার নির্দেশনায় জাকারিয়া আহমদের জামিন হয় বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
ওই সূত্রটি আরো জানায়, এ্যাডভোকেট সাঈদ আহমদ মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ডেভিল জাকারিয়াকে জামিন করান। আর এই জামিনে তাকে সর্বাত্মক সহযোগীতা করেন শ্রমিকদল নেতা মো. আলী আকবর রাজন। জামিনকালে আদালতে উপস্থিত ছিলেন সিলেট জাতীয়তাবাদী আইনজীবিদের আরো ক’জন সিনিয়র এ্যাডভোকেট। তারাও নীরব ভূমিকা পালন করেন। শুধু তাই নয়, ডেভিল জাকারিয়া একজন শ্রমিক নেতা, আদালতে কোনো ধরণের উশৃংখলা সৃষ্টি না হয় এর জন্য তাদের কোর্ট থেকে নামতে সহযোগীতা করেন।
আদালতে জামিনকালে উপস্থিত ছিলেন বলে নিউজ মিররের কাছে স্বীকার করেন এ্যাডভোকেট সাঈদ আহমদ। তিনি জানান, প্রতিকুল পরিবেশ নিয়ন্ত্রনের জন্য তারা সহযোগীতা চেয়েছেন। তিনি সহযোগীতা করেছেন। ওকালতনামা প্রসঙ্গে তিনি জানান, এসব উনার না।
এদিকে ডেভিল জাকারিয়া আহমদকে গ্রেফতারের মাত্র ১২ ঘন্টার ব্যবধানে জামিনে মুক্ত হওয়ায় ঘটনায় সিলেটজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এছাড়াও কোর্ট প্রাঙ্গনে প্রকাশ্যে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ডেভিল জাকারিয়ার পক্ষে জাতীয়তাবাদী শ্রমিকদলের সিলেট জেলার যুগ্ম আহবায়ক, সিলেট জেলা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহবায়ক ও পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক সম্পাদক মো. আলী আকবর রাজন সাফাই গেয়ে সিলেট বিএনপিকে বিতর্কৃত করার অভিযোগে (কারণ দর্শানোর নোটিশ) শোকজ করা হয়েছে তাকে। এছাড়াও একজন ডেভিলের জামিনের বিরোধীতা না করার কারনে এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন হচ্ছে এবং সিলেটের জাতীয়তাবাদী আইনজীবিদের ক’জন সিনিয়র এ্যাডভোকেটকেও এঘটনায় শোকজ করা হচ্ছে।
মূলত, এই জামিনের মূল কারিগর আলী আকবর রাজন। তার পরিকল্পনায় এই জামিন হয়। মঙ্গলবার সকালে জাকারিয়াকে থানা থেকে আদালতে প্রেরণ করা হলে সেখানে জড়ো হন আলী আকবর রাজনসহ ডেভিল জাকারিয়ার অনুসারীরা। সাথে ছিলেন পরিবহন শ্রমিক নেতারাও। তারা আদালত প্রাঙ্গনে এসে জাকারিয়ার মুক্তির দাবী করেন। সেই পুরনো হুমকি আবার শুরু করেন শ্রমিকরা। সিলেট নগরজুড়ে তারা গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে ডেভিল জাকারিয়ার মুক্তির জন্য চাপ সৃষ্টি করে। এসময় জাকারিয়ার মুক্তির জন্য প্রকাশ্যে বক্তব্য দেন আলী আকবর রাজন। এসময় আদালত প্রাঙ্গনে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপি সমর্থিত কয়েকজন আইনজীবি জানান, জামিন কালে আদালতে অদৃশ্য কারণে জাতীয়তাবাদী আইনজীবিরা নীরব ভূমিকা পালন করেন।
অপরদিকে, মঙ্গলবার রাতে সিলেট জেলা শ্রমিকদলে ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক শাহ আব্দুল মুকিত ও সদস্য সচিব নুরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক নোটিশে আলী আকবর রাজনকে আাগমী তিন দিনের মধ্য কারন দর্শানোর জন্য বলা হয়েছে। অন্যথায় সাংগঠনিক ব্যবস্হা গ্রহন করা হবে।
নিজেকে বিতর্ক থেকে নিজের ফেসবুক আইডিতে ২ লাইনের সাফাই গেয়ে আলী আকবর রাজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষমা চেয়েছেন। মো. আলী আকবর রাজনের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ এসেছে। এসব অভিযোগের তদন্ত চলমান। পর্যায়ক্রমে তাও প্রকাশ করা হবে।
এরআগে সোমবার (২৮ এপ্রিল) দিবাগত রাত দেড়টার দিকে মো. জাকারিয়া আহমদকে মদিনা মার্কেটস্থ তার নিজ বাসা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মঙ্গলবার দুপুরে তাকে আদালতে তোলা হলে আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন। শ্রমিকলীগ নেতা জাকারিয়া নানা কারণে সিলেটে ছিলেন আলোচিত।
জাকারিয়ার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ, সিলেটের পরিবহন সেক্টরে রয়েছে শ্রমিক নেতা জাকারিয়ার একক আধিপত্য। আওয়ামী লীগ সরকারে আমলে বিএনপি-জামায়াত হরতাল দিলে সড়কে গাড়ি সচল রাখার দায়িত্ব ছিল তার। আবার বিএনপি জামায়াত কর্মসূচি দিলে নানা ইস্যু সৃষ্টি করে কর্মবিরতির নামে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দিতেন তিনি। এনিয়ে সাধারণ যাত্রীরাও ছিলেন জাকারিয়ার উপর ক্ষুব্ধ। জাকারিয়া আহমদ কারান্তরীণ ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবেও সিলেটে ছিলো ব্যাপক পরিচিতি।
অভিযোগ রায়েছে আওয়ামী লীগের সাবেক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরীর উপরও হামলা করিয়েছিলেন এই জাকারিয়া আহমদ। সিলেটের পলাতক আওয়ামী লীগ নেতারা যখন খুশি তখন এই জাকারিয়াকে দিয়ে শ্রমিক আন্দোলনের নামে সিলেটকে উত্তপ্ত করতো। তার এই কর্মকান্ডে সিলেটবাসী নানা ভোগান্তিতে পড়তেন। মঙ্গলবারও ডেভিল জাকারিয়া আহমদের পক্ষ নিয়ে আন্দোলনের ডাক দেয় শ্রমিকরা। পরে তাদের নিবৃত করার নাটক মঞ্চস্হ করে আলী আকবর রাজন ও আওয়ামী লীগ নেতা মঈনুল ইসলাম। ৫ আগস্টের পর এটাই তাদের ছিলো অঘোষিত প্রথম অবরোধ। তারা আবারও ফ্যাসিবাদীদের হয়ে সিলেটকে তাদের আয়ত্বে নেয়ার চেষ্টা করছে। যা বিগত ১৬ বছর করে আসছিল।
অপরদিকে, ডেভিল জাকারিয়া আহমদকে জামিনের পর পরই আদালত পাড়ায় খবর রটে সিলেট জেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক ও সাবেক জেলা ছাত্রদলের সভাপতি এ্যাডভোকেট সাঈদ আহমদের উকালতনামায় জামিন পান সিলেটের অন্যতম বিতর্কিত ও আলোচিত শ্রমিকলীগ নেতা ডেভিল জাকারিয়া।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একজন প্রবীন বিএনপি নেতা বলেন, পাঁচটি রাজনৈতিক মামলায় সাবেক কাউন্সিলর রেজওয়ান আহমদ ও তার ভাই কামরান আহমদের জামিনের পর সিলেটে তোলপাড় শুরু হয়। এখন আরো এক ডেভিল জামিনে মুক্ত হল। অবশ্যই এখানে সিলেট জাতীয়তাবাদী আইনজীবিরা জড়িত। এদের শুধু শোকজ নয়। বহিস্কার করা দরকার। এরাই আদালতে ৫ আস্টের পর মামলা বাণিজ্য করে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। কেন্দ্রের নির্দেশনা অবজ্ঞা করে নিজেদের পকেট ভারি করছে ওরা।