বিশেষ প্রতিবেদক
ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর হরিলুটে জড়িতদের প্রাথমিক তালিকা তৈরী করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রাথমিক তালিকায় উঠে এসেছে ১০৩ জনের নাম। তালিকাটি এখন যাচাই–বাছাই করে দেখা হচ্ছে। এর পরই পাথর লুটেরাদের ধরতে তালিকা হাতে নিয়ে অভিযান শুরু হবে। এমন তথ্য জানিয়েছেন, সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ।
তিনি বলেন, ‘পাথর লুটপাটে জড়িত ব্যক্তিদের একটি প্রাথমিক তালিকা করেছে পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এখন যাচাই–বাছাই করে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে।’
এদিকে, সাদাপাথর হরিলুটের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩২ টি মামলা হয়েছে। স্থানীয় প্রসাশন, পুলিশ ও পরিবেশবাদীদের অভিযোগে ১৭ জনের নাম প্রকাশ পেয়েছে। তারা হলেন- কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সদ্য বহিস্কৃত সভাপতি সাহাব উদ্দিন, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদলের আহবায়ক সাজ্জাদ হোসেন দুদু, সিলেট জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহার আহমেদ রুহেল, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা শ্রমিক দলের সাবেক সভাপতি লাল মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান আলমগীর আলম, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক দপ্তর সম্পাদক দুলাল মিয়া দুলা, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সদস্য মানিক মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদল নেতা জাকির হোসেন, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সদস্য শাহাব উদ্দিন, পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়নের যুবলীগ সভাপতি আলীম উদ্দিন, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক রজন মিয়া, তেলিখাল ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজিম উদ্দিন, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সদস্য হাজী কামাল, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদল কর্মী শৈবাল শাহরিয়ার সাজন, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদল কর্মী আজিজুল মাহমুদ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাদাপথর লুটের সাথে আরো জড়িত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক রজন মিয়ার ভাই আজিজ মিয়া; সাহাব উদ্দিনের বোনের জামাই ও যুবদল নেতা জসিম উদ্দিন; তাঁর ভাই সাজন মিয়া; বহিস্কৃত সাহাব উদ্দিনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত মোজাফর আলী, জেলা যুবদলের সহ সম্পাদক বাহার আহমেদ রুহেলের ভাই গিয়াস উদ্দিন; উপজেলা যুবদলের সদস্য নিজাম উদ্দিন; উত্তর রনিখাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য তরিক উল্লাহ মেম্বার; নৌকা মার্কায় নির্বাচিত ৫নং উত্তর রনিখাই ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ফয়জুর রহমান; সাবেক স্বেচ্ছাসেবক লীগ কর্মী জিয়া উদ্দিন।
এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের কর্মী পূর্ব ইসলামপুর ইউপির সদস্য কাজল সিংহ, আওয়ামী লীগ কর্মী মনির মিয়া (অন্য মামলায় বর্তমানে কারাগারে), হাবিল মিয়া ও সাইদুর রহমান।
সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে একটা তালিকা তৈরি হয়েছে। এটি যাচাই–বাছাই শেষে চূড়ান্ত করা হবে। এরপর দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত সব পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে যেসব অভিযুক্ত শনাক্ত হচ্ছেন, তাঁদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানান, পাথর লুটপাটকারীদের তালিকায় লুটপাটে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে রাজনৈতিক দলের নেতা ও এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিরা আছেন। পাশাপাশি লুটপাটে ব্যবহৃত বারকি নৌকার মালিক এবং পাথর ক্রয়-বিক্রয়ে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরাও আছেন।
তবে, শনিবার ভোরে সাদাপাথর লুটের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া পাঁচজনের নাম ওই তালিকায় আছে কী-না তা নিশ্চিত করতে পারেননি কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের আল মাহমুদ আদনান। তিনি বলেন, শুক্রবার দায়ের হওয়া খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাঁদের আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তাদের কারাগারে প্রেরনের নির্দেশ দেন।
ওসি জানান, শুক্রবার (১৫ আগস্ট) রাতে ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি থেকে অবৈধভাবে পাথর লুট ও চুরির ঘটনায় প্রায় দেড় হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে কোম্পানীগঞ্জ থানায় মামলাটি দায়ের করেন খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর মহাপরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ারুল হাবীব। এতে খনি ও খনিজ সম্পদ (নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন) আইন, ১৯৯২-এর ধারা ৪(২)(ঞ) এবং খনি ও খনিজ সম্পদ বিধিমালা, ২০১২-এর বিধি ৯৩(১) লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী সময়ে গেজেটভুক্ত ওই কোয়ারি থেকে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীরা কোটি কোটি টাকার পাথর অবৈধভাবে উত্তোলন ও লুট করেছে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে জাতীয় গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। তবে আসামিদের সুনির্দিষ্ট পরিচয় এখনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
প্রশাসনের নাকের ডগায় হরিলুট হয়েছে ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর। এতে সরগরম হয়ে ওঠে পুরোদেশ। নানা মহলের সমালোচনার পর অবশেষে পর্যটন শিল্পে ভিন্ন মাত্রা যোগ করা এই পাথর আগের স্থানে ফেরানো হচ্ছে। তবে পাথর ফিরতে শুরু করলেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে অনেক। কী পরিমাণ সাদাপাথর লুট হয়েছে- সে তথ্য যেমন নেই প্রশাসনের কাছে, তেমনি কারা পাথর লুটে কারা জড়িত- সেই তালিকাও নেই তদারকির দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থা, দপ্তরগুলোর হাতে!
স্থানীয়রা বলছেন, সাদাপাথর একদিনেই লুট হয়নি। বছরের পর বছর ধরেই চলছে লুটপাট। সাম্পতিক সময়ে রেকর্ড লুটপাট হয়েছে। দিন ও রাতে সমানতালে শত শত মানুষ লুটপাটে অংশ নিয়েছে। রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছত্রছায়ায় পাথর লুটের মহোৎসব চললেও নিরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ পুরো প্রশাসন।
স্থানীয়রা বলছেন, প্রতিদিন যে হারে পাথর লুটে নেয়া হয়েছিল, ফিরছে তার তুলনায় অতি নগণ্য। তাই দৃষ্টিনন্দন এ পর্যটনকেন্দ্র সহসাই আগের রূপে ফিরবে কি না, তা নিয়ে আছে সংশয়।
২০১৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন শাহ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসনের চেষ্টায় সেসব পাথর সংরক্ষিত হয়েছিল। তখনকার জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার ও ইউএনও আবুল লাইছ নিজ উদ্যোগে পাহারার ব্যবস্থা করেছিলেন। এরপর উপজেলা প্রশাসন সংরক্ষণের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। সর্বশেষ সুমন আচার্য ইউএনও থাকাকালে সাদা পাথর নিয়ে একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করেন। সেটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় এলাকাটি ঝুঁকির মুখে পড়ে।
সাদা পাথর যাওয়ার ঘাট হিসেবে পরিচিত ধলাই নদতীরের ভোলাগঞ্জের ১০ নম্বর এলাকা। সেখানকার স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক পাহাড়ি ঢলে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পর্যটকরা সাদা পাথরে যাননি। এই সুযোগে শুরু হয় লুটপাট। দিন ও রাতে হাজার খানেক বারকি নৌকা ব্যবহার করে সপ্তাহদিন ধরে পাথর লুট চলে। অনেকটা মব স্টাইলে হওয়ায় ভয়ে পুলিশ প্রশাসনও ছিল সাক্ষী-গোপালের ভূমিকায়।