নিউজ মিরর ডেস্ক
নিউইয়র্কে রিয়েল এস্টেটের নামে চলছে ভয়ংকর প্রতারনা। একটি প্রতারক চক্র জাল স্বাক্ষরে বাড়ির মালিকানা সেজে বাড়ি দখলে রেখে ভাড়া আদায় করছে। অপরদিকে মূল মালিকের নামে মর্টগেজের বকেয়া অর্থ সুদসহ বাড়ছে মাসের পর মাস ধরে। এছাড়াও এই চক্রের সদস্যের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বাড়ির মালিককে দেয়া হচ্ছে হুমকি-ধামকি, এমনকি অপহরণের চেষ্টা। আদালতের নিষেধাজ্ঞা নিজের বাড়ির আশ-পাশে যেতে পারছেন না ভুক্তভোগীরা। এই চক্রের টার্গেট মূলতো এশিয়ানরা।
এই চক্রের সদস্যরা কম্যুনিটির বিভিন্ন সংগঠনের সংবর্ধনায় চাঁদার বিনিময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মঞ্চে উঠা কিংবা সংবর্ধনা পাওয়া অথবা মেয়র, গভর্ণর, সিনেটর-কংগ্রেসম্যানসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের কাছে থেকে ক্রেস্ট অথবা সাইটেশন গ্রহণের মাধ্যমের ছবি দেখিয়ে সহজ-সরল এশিয়ান প্রবাসীদের সামনে ‘জনদরদি’, ‘সমাজসেবক’ ইত্যাদি লেবাসে আবির্ভূত হচ্ছে। কেউ কেউ আবার পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তার সাথে দহরম-মহরমকেও এই অপকর্মের অন্যতম অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করছে।
নিউইয়র্কে রিয়েল এস্টেট সেক্টরে জালিয়াতি-প্রতারণা, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, ব্যাংক জালিয়াতি, অপহরণ ইত্যাদি মামলায় ইতিপূর্বে জেল খাটা/কনভিক্টেড (আসামী) কতিপয় প্রবাসীও নবউদ্যমে এই চক্রের সদস্য হচ্ছে। সামাজিক-আঞ্চলিক সংগঠনের তহবিল চুরি করে নিজের নামে বাড়ি ক্রয় কিংবা কবরের জায়গা বিক্রির নামে প্রতারণার ফাঁদ পাতার মত ভয়ংকর অপকর্ম করেই চলেছে। করোনা মহামারির ভয়ংকর প্রভাব থেকে রক্ষা পাবার পর কম্যুনিটির প্রত্যাশা ছিল যে সকলেই শুদ্ধ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হবেন। অন্তত: প্রতারণা-ধান্দাবাজি, অন্যের গোপন তথ্য চুরি করে পিপিপি লোন অথবা বেকার ভাতা হাতিয়ে নেয়ার মত বেআইনী কর্মকান্ড থেকেও বিরত থাকবেন সংশ্লিষ্টরা-এমন প্রত্যাশাও ছিল সকলের। কিন্তু চোর শোনে না ধর্মের কাহিনী।
চলতি বছরে নিউইয়র্কের কুইন্সের মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণসহ নানাবিধ অপকর্মের মামলায় স্বামী-স্ত্রীসহ ৬ জন প্রবাসীকে গ্রেফতার করা হয়। এরপরও এই চক্রের সদস্যরা সতর্ক হয়নি। বরং প্রতারণা/জালিয়াতির ঘটনা আরো বেড়েছে। তারা এতটাই বেপরোয়া হয়েছে যে, বারবার ফোন করে এক প্রবাসীকে হুমকি দিচ্ছে বাসা ত্যাগ করার জন্য।
নর্দার্ণ বুলেভার্ডে এক প্রবাসী গত মাসের ২ তারিখ সপরিবারে তিনি ক্যানসাসে বেড়াতে যান। পরে ৯ জুলাই ফিরে দেখেন যে, তার বাসায় তালা ভেঙ্গে চুরি হয়েছে। সবকিছু তছনছ, নগদ চার হাজার ডলার, স্বর্ণালংকার, ৫টি পাসপোর্ট, গুরুত্বপূর্ণ ডক্যুমেন্টসহ পোশাক-আশাক সবকিছু চুরি হয়েছে।
সংঘবদ্ধ একটি চক্র এই অপকর্ম করেছে বলে তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন (কেস নম্বর-২০২৫-১১৫-৬৩২৫)। এর প্রেক্ষিতে ডিটেকটিভ তদন্ত শুরু করে। তবে এখোন পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। এর আগে তার বাসার পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। বিল্ডিং ডিপার্টমেন্ট থেকে ভায়োলেশনের নোটিশও এসেছে। সবকটিই ভৌতিক।
ফরিদপুর অঞ্চলের সন্তান ফখরুল বিস্ময়ের সাথে জানান, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাদের দেখি অতিথি হিসেবে-তার মধ্যে কিছু লোক এমন অপকর্মে লিপ্ত তা ভাবতেও অবাক লাগে।
ফখরুল জানালেন, এই বাড়িটির প্রকৃত মালিক হচ্ছেন বাংলাদেশী সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল। জাল দলিল করেছে প্রতারক চক্র। আগে থেকেই আমি ভাড়ায় রয়েছি এই বাসায়। সেজন্যে লড়াই করছি জালিয়াতি চক্রের বিরুদ্ধে। এ সময় সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল বললেন যে, তার কেনা বাড়ির মধ্যে ৪টির দলিল জালিয়াতি করে অনেক হয়রানি করেছে দুর্বৃত্ত চক্রটি। আর এসব অপকর্ম চালায় রিয়েল এস্টেট এজেন্ট/ব্র্কোার হিসেবে পরিচিতরা।
আমি আইনী লড়াই করে সবকটি বাড়ি দুর্বৃত্তচক্রের কবল থেকে উদ্ধারে সক্ষম হলেও অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে অযথা। টেনশনে আমার বয়সও বেড়েছে। আর ওই প্রতারক চক্রের অন্যতম হলেন আদিল নাবিল, যাকে সম্প্রতি কুইন্সের পুলিশ গ্রেফতার করেছিল।
জ্যামাইকায় ৮৬-৮৪ ১৮৮ স্ট্রিটের বাসিন্দা বিশিষ্ট সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী, কমিউনিটি নেতা ও সাবেক ছাত্রনেতা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী জাহিদ খান বললেন, আদিল নাবিল যাতে আমার আশে পাশে না আসতে পারে সেজন্যে কুইন্স ক্রিমিনাল কোর্ট থেকে ১৩ জুলাই একটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে এবং সেটি বহাল থাকবে সামনের বছর ১২ জুলাই পর্যন্ত। একইসময়ে দৃর্বৃত্ত চক্রের অপর সদস্য আমার বিরুদ্ধেও পুলিশে অভিযোগ করেছিল যে, কুইন্স ভিলেজে আমার মালিকানাধীন বাসার সামনে তার পার্ক করা গাড়ি নাকি আমি ভাঙচুর করেছি। সেজন্যে গত ১২ জুলাই আমাকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। এরপর আমি যাতে ওই বাসায় তথা সামির লিয়ন এবং মুহিতুদ্দিন মালিকের আশে পাশে না যাই সামনের বছর ১২ জুলাই পর্যন্ত-সেই নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
গতবছর ১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত মধ্যরাতে জাহিদ এ খানকে লাঞ্ছিত করার মামলায় মুহিতুদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সেই মামলায় মুচলেকা দিয়ে রেহাই পেলেও মুহিত ওই চক্রের সাথে এখনো জড়িয়ে রয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে এবং জাহিদের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগের মাধ্যমে সেটি দৃশ্যমান হয়। জাহিদ খানের ওপর হামলার মামলায় গত ১৭ ডিসেম্বর সকালে এই চক্রের সদস্য নিশু চৌধুরীকে গ্রেফতার করেছিল নিউইয়র্কের পুলিশ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুহিতুদ্দিনের এক নিকটাত্মীয় রয়েছেন নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে। এই পরিচয়কেও কাজে লাগাচ্ছে মুহিতুদ্দিন-এমন গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। বেশ ক’বছর আগে নিউইয়র্ক পুলিশ কমিশনার এমন অভিযোগে (ডিসিপ্লিনারি কেস নম্বর-২০১২-৭০৯৬) তলব করেছিলেন (২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর) মুহিতুদ্দিনের ওই আত্মীয়কে। ডিউটিতে ছিলেন না এমন সময়ে এমন কোন আচরণ করেছিলেন যা পুলিশ বাহিনীর আচরণের পরিপন্থি হিসেবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়েই তলব করেছিলেন বলে জানা গেছে। তারপরও মুহিতুদ্দিনের গতি-প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসেনি বলে অভিযোগ করেছেন জাহিদ খান।
ভিকটিম জাহিদ খান জানান, কুইন্সের এই চক্রটি রিয়েল এস্টেট এজেন্ট/ব্রোকার হিসেবে আবির্ভূত হয়ে বাড়ি ক্রয়ে আগ্রহীর সকল তথ্য হাতিয়ে নেয়ার পরই শুরু করে দুর্বৃত্তপনা। বাড়ি ক্লোজিংয়ের পর্যায়ে অথবা ক্লোজিংয়ের পর ক্রেতার স্বাক্ষর জাল করে ওরা। আমার স্ত্রী এবং মায়ের স্বাক্ষর জাল করে ২৬৩১ ৯৮ স্ট্রিট, ইস্ট এলমহার্স্ট এবং ২৪৪৩১ ৮৮ রোড, বেলরুজের বাড়ি দুটি দেখলের চেষ্টা করছে। এ দুটির ভাড়াটে তাড়িয়ে ওরা নতুন লোককে ভাড়া দিয়েছে এবং মাসিক ভাড়া উঠাচ্ছে। অথচ প্রকৃত মালিক হিসেবে আমাদেরকেই ব্যাংক-ঋণের মাসিক কিস্তির যাতনা সইতে হচ্ছে। এমন উদ্ভট আইনের দেশ এটি।
সাখাওয়াত এবং জাহিদ জানালেন যে, এই চক্রের চিহ্নিত কয়েকজন করোনাকালিন বিশেষ অনুদানের অর্থ এবং বেকার ভাতাসহ পিপিপি লোনের অর্থ ড্র করেছে। কম্যুনিটি লিডার/রিয়েল এস্টেট ব্রোকার হিসেবে সংগৃহিত তথ্য সরবরাহ করে ড্র করা লোনের অর্থ তারা আত্মসাৎ করেছে। এমনকি, করোনায় মারা যাওয়া কয়েকজনের নামেও পিপিপি লোন ড্র করেছে এবং এখনো তদন্ত চালালে দেখা যাবে যে তারা মৃত ব্যক্তির নামে ফুডস্ট্যাম্প ড্র করছে। কারণ এরা এতটাই বেপরোয়া যে, অর্থের লোভে স্বজনকেও অন্যের বিছানায় দিতে দ্বিধা করে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এই চক্রের একজন সদস্য মূলধারার রাজনীতির নামেও বোর্ড অব ইলেকশনের সাথে প্রতারণা করেছে বলে কম্যুনিটিতে গুঞ্জন রয়েছে। আরেকজন ভারতীয় পাসপোর্টধারী ‘দানবির সেজে কিংবা হোমকেয়ার এজেন্ট সেজেও সহজ-সরল প্রবাসীগণের সাথে প্রতারণা করছে হরদম।
জাহিদ খান বললেন, পছন্দের বাড়ির দাম নির্দ্ধারণ নিয়েও ছলচাতুরি করা হয়। এমনকি, ঐ চক্রের পছন্দের আইনজীবী দিয়ে ক্লোজিংয়ে চাপ দেয়া হয়। অর্থাৎ সবকিছু ওদের নখদর্পনে চলে যায়-যা প্রতারণার ফাঁদ সুগম করে। জাহিদ খানের অভিযোগ, এই চক্রটি আমেরিকায় স্বপ্নের বাড়ি ক্রয়ে আগ্রহী ব্যক্তিকে এমনভাবে প্রলুব্ধ করে যে, সঞ্চিত ৫০/৬০ হাজার ডলারও হাতিয়ে নিয়ে থাকে। প্রতি মাসে ২/৩ হাজার ডলার করে লাভের টোপ দিয়ে সর্বনাশ করা হচ্ছে প্রবাসীদের।
নোয়াখালীর সন্তান আনোয়ারুল কবির রানা এই চক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বশান্ত হয়েছেন। আদালতে দৌড়াচ্ছেন খোয়া যাওয়া অর্থ উদ্ধারের জন্যে।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ভারতীয়, পাকিস্তানী এবং বাংলাদেশী কয়েকজনের সমন্বয়ে এই দুর্বৃত্তরা মাঝেমধ্যেই নানা পরিচয়ে আবির্ভূত হচ্ছে। স্টেট গভর্ণর, সিটি মেয়র, ডিস্ট্রিক্ট এটর্নী, স্টেট সিনেটর, স্টেট অ্যাসেম্বলীম্যান, কংগ্রেসম্যান অথবা সিনেটরের পাশে দাঁড়িয়ে ছবিতে পোজ দেয়া ছাড়াও কম্যুনিটিভিত্তিক কোন কোন সমাবেশে অতিথি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এভাবে নবাগত প্রবাসীরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন এবং ওদেরকে ‘ভালো মানুষ’ ভেবে ব্যবসা অথবা রিয়েল এস্টেট সেক্টরে ব্যবসায় বিনিয়োগ করছেন। কেউ কেউ বিজনেস এসোসিয়েশনের নেতা হিসেবে কিংবা সমাজকল্যাণ মূলক সংগঠনের একজন হিসেবে পরিচয় দিয়ে সর্বস্ব হাতিয়ে নিচ্ছে। উল্লেখ্য, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী রিয়েল এস্টেট কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যে পার্টনার হিসেবে বিনিয়োজিত অর্থ উদ্ধার করা খুবই কঠিন। সেই সুযোগটি নিচ্ছে সংঘবদ্ধ এই প্রতারক চক্র।
সূত্র জানিয়েছে, কয়েক বছর থেকে বেশ কিছু প্রবাসীর সাথে প্রতারণার ঘটনাগুলো এফবিআইয়ের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ডিটেকটিভ পুলিশের পাশাপাশি এফবিআইও মাঠে নেমেছে। ইতিমধ্যেই তার কিছু আলামত হিসেবে এই চক্রের সাথে সম্পর্ক থাকা কয়েকজন গ্রেফতার হয়েছে অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়ের মামলায়। কারো কারো শরীরে সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের ‘বিশেষ যন্ত্র’ লাগিয়ে জামিন প্রদানের সংবাদও পাওয়া গেছে।
প্রতারনার শিকার জাহিদ খান।
জালালাবাদ এসোসিয়েশনের সমাজকল্যাণ সম্পাদক জাহিদ খান দু:খ করে বললেন, আমার এই চরম দু:সময়ে পাশে পাচ্ছি না সহকর্মীগণকে। অথচ ভোট নেয়ার সময় কত অঙ্গিকার করা হয়। বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতিকেও অবহিত করেছি একাধিকবার কিন্তু তিনি কোন গুরুত্বই দেননি। এজন্যে আদালতই আমার শেষ ভরসা। সেখানেই লড়ছি। সেখানেও আইনজীবীরা সহযোগিতা দিতে কার্পণ্য করছেন। কারণ রিয়েল এস্টেট প্রতারণার মামলা নিষ্পত্তিতে অনেক সময় লাগে, এটা নাকি তাদের পোষায় না।