বিশেষ প্রতিবেদক
হঠাৎ করে সিলেটে বেড়েছে ছিনতাই। দীর্ঘদিন নগরবাসী অনেকটা নির্বিঘ্নে ছিল। ছোটখাটো ছিনতাইয়ের খবর মাঝেমধ্যে শোনা যেত। তবে বড় কোনো ঘটনার খবর নিকট অতীতে নেই। অনেক দিন পরে আবার নগরবাসীর মধ্যে দেখা দিয়েছে ছিনতাই আতঙ্ক। ৫ আগস্টের পর থেকে শহর ও শহরতলির নানান স্থানে হরহামেশা ছোটখাটো ছিনতাইয়ের খবর আসছিল। গত সোমবার দুপুরে বড়সড় একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে নগরীতে। নগরীর মিরাবাজার এলাকায় সিএনজি অটোরিকশাযাত্রী এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৪২ লাখ টাকা ছিনতাই হয়। এর ঠিক কিছু সময় পর মিরাবাজারের পার্শ্ববর্তী সোবহানীঘাট পয়েন্ট এলাকায় আরেকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটি সংঘঠিত হয় পুলিশ ফাঁড়ির মাত্র ৫০ গজের মধ্যে। দুটি ছিনতাইয়ের ধরন ছিল একই। ছিনতাইকারীরা ব্যবহার করেছে মোটরসাইকেল। ঘটনার পর তাদের যাত্রাপথও ছিল একই দিকে। এ খবর শহরে চাউর হলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বতর্মানে নগরবাসী ছিনতাই আতঙ্কে ভোগছে। তারা বাইরে বেরোচ্ছে ভয়ে ভয়ে।
ছিনতাইকারীরা টার্গেট করে নামছে অভিযানে। টাকা ও মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনতাই করে নেওয়ার সময় ছুরিকাঘাতে মারাত্মক আহতও করছে তারা।
নগরবাসী বলছেন, পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা ও দুর্বল নজরদারি এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণেই সিলেটে ছিনতাই বেড়েছে। শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ানের (র্যাব) সক্রিয়তা আগের মতো অতটা চোখে পড়ছে না। তবে সিলেট মেট্রোপলিটন পলিশ (এসএমপি) জানিয়েছে, পুলিশ মাঠে দায়িত্ব পালন করছে। ঘটনার পর আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে পুলিশ ও র্যাব।
এসএমপির উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম সিলেটে হঠাৎ ছিনতাই বেড়ে যাওয়াকে অ্যালার্মিং হিসেবেই দেখছেন। বলছেন, শীত এলেই সিলেট অঞ্চলে ছিনতাই বেড়ে যায়। তবে এবারের ছিনতাইকে হালকাভাবে নিচ্ছে না এসএমপি। এরই মধ্যে ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে কাজ শুরু হয়েছে। অনেককে চিহ্নিতও করা গেছে। দ্রুত সময়ে ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার ও অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন, এরা জানমালের নিরাপত্তার হুমকি। তাদের দমনে পুলিশ কোনো আপস করবে না।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সোমবার নগরীর শিবগঞ্জ ফরহাদ খাঁ পুলের সামনে এক ব্যবসায়ীর ৪২ লাখ টাকা ছিনতাই হয়। দুপুর ১টা ৪০ মিনিটের দিকে ফরহাদ খাঁ পুলের ইয়ামাহা মোটরসাইকেল শোরুমের সামনে এই ছিনতাই হয়। ওই ব্যবসায়ী এনআরবি ব্যাংক চৌহাট্টা শাখা থেকে টাকা ক্যাশ নিয়ে সিএনজি অটোরিকশাযোগে শিবগঞ্জের বাসায় যাচ্ছিলেন। ঘটনাস্থলে তিনি পৌঁছামাত্র তিন মোটরসাইকেলে ছয় ছিনতাইকারী এসে টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, এই ছিনতাইয়ে ব্যবহার করা হয়েছে ‘সিলেট হ/ল ১১-০১৪৫’ লাল রংয়ের মোটরসাইকেল।
এদিকে এর ঠিক কিছু সময় পরে বিকেল ৪টা ১০ মিনিটের দিকে আব্দুস সামাদ নামের এক ব্যক্তি রিকশাযোগে কদমতলী যাওয়ার পথে সোবহানীঘাট পুলিশ ফাঁড়ির অদূরে ইবনে সিনা হাসপাতালের কাছে ছিনতাইয়ের শিকার হন। তিনি নগরীর প্রাইম ব্যাংক লালদীঘির পাড় শাখার কর্মকর্তা। তাকে ছুরিকাঘাতে মারাত্মকভাবে আহত করা হয়। তার কাছ থেকেও নগদ অর্থ, পাসপোর্টসহ মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এ সময় পয়েন্টে একাধিক ট্রাফিক পুলিশও দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ ঘটনায়ও তিন মোটরসাইকেলে ছিল ছয় ছিনতাইকারী। অপারেশন শেষে ছিনতাইকারীরা যতরপুরের দিকে চলে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, দুটি ছিনতাই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিনতাইকারীদের যোগসূত্র থাকতে পারে। ঘটনার পর আব্দুস সামাদ কতোয়ালী থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করেছেন।
সূত্রমতে, সিলেট নগরীতে এখন যত ছোটবড় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে, তা একে অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত। ছিনতাইকারী সিন্ডিকেট পরিকল্পিতভাবে এই অপকর্ম করছে। নগরে ছিনতাইয়ে দক্ষিণ সুরমা, শিবগঞ্জ, মিরাবাজার, সুবিধবাজার ও কাজলশাহ গ্রুপ বেশি সক্রিয়। পেশাদার ছিনতাইকারী ছাড়াও এর সঙ্গে জড়িত আছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এ দুই গ্রুপ মিলে ছিনতাই অপারেশন চালাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
নগরীতে ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার পর আলোচনায় বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের নাম উঠে এসেছে। যদিও সরাসরি দলের কেউ এসবে জড়িত থাকলে তাদের ছাড় দিতে নারাজ দলটি। স্থানীয় শীর্ষ নেতারা এ নিয়ে কঠোর অবস্থানে। তারা কোনোভাবে দলের দুর্নাম হতে দিতে রাজি নন। ইতিমধ্যে এরকম নানা অভিযোগে কয়েকজনকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে সিলেট বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠন।
একাধিক সূত্রের দাবি, দল থেকে বহিষ্কৃত এসব দুষ্কৃতকারীই দলের সুনাম ক্ষুণ্ন করছে, যাতে বিএনপি বা যুবদল-ছাত্রদলের কেউ জড়িত নন। এদের পাশাপাশি রয়েছে পেশাদার পকেটমার ও ছিনতাইকারীও। আছে কিশোর গ্যাং, যারা গত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় সিলেটে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছিল। ধাপিয়ে বেড়িয়েছিল শহর। অভিযোগ আছে, তখন এই কিশোর গ্যাংকে পোষতেন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতারা। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর তারা নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বেশিসংখ্যকই হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। তারা বেকার ও পড়াশোনার বাইরে থাকা। ফলে আর্থিক চাহিদা মেটাতে তারা জড়িয়ে পড়ছে ছিনতাই ও চাঁদাবাজিতে।
সূত্র জানায়, সিলেটের শিবগঞ্জ ও এর আশপাশ এলাকা এবং দক্ষিণ সুরমাকেন্দ্রিক ছিনতাইকারী দুটি গ্রুপ বেশির ভাগ ছিনতাইয়ে জড়িত। এ দুই জায়গা থেকেই মূলত অপারেশন পরিচালনা করা হয়। এদের সঙ্গে রয়েছে একসময় রাজনৈতিক দলে জড়িত ছিল এবং কেউ কেউ এখন বহিষ্কৃত; দক্ষিণ সুরমার এমন অন্তত পাঁচ নেতাকর্মীর পাশাপাশি শহরের আরও সাত-আটজনের আলাদা গ্রুপ ছিনতাইয়ে জড়িত বলে জানিয়েছে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র।
সূত্র : সালমান ফরিদ, রূপালী বাংলাদেশ