বিশেষ প্রতিবেদক
সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফের স্বর্ণের চালান ধরা পড়েছে। এবার অভিনব পন্থায় শুল্ক ফাঁকি দিয়ে দুবাই থেকে নিয়ে আসা গলানো স্বর্ণের বড় চালান জব্দ করলো জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। আটক ব্যক্তির নাম আলীম উদ্দিন (৪০)। তিনি সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার বাসিন্দা।
কাস্টমস সূত্র জানায়, আলীম উদ্দিন বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে দুবাই থেকে দেশে ফেরেন। তার টিকিট ছিল ঢাকার জন্য, তবে সন্দেহভাজন হওয়ায় তাকে সিলেট বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ থেকে নামিয়ে আনে কাস্টমস ও এনএসআইয়ের একটি দল। পরে স্ক্যানার পরীক্ষায় দেখা যায়, তার পরিহিত পোশাকে গলানো স্বর্ণর প্রলেপ রয়েছে।
আটকের সময় আলীম উদ্দিনের পরিহিত চারটি অন্তর্বাস, দুটি গেঞ্জি, একটি শার্ট ও একটি প্যান্ট জব্দ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বর্ণ বহনের বিষয়টি স্বীকার করেছেন বলে কাস্টমস জানিয়েছে।
সিলেট কাস্টমসের সহকারী কমিশনার (অতিরিক্ত দায়িত্ব, বিমানবন্দর ও এয়ারফ্রেইট বিভাগ) ইনজামাম উল হক বলেন, “আটক যাত্রীর পরিধেয় পোশাকে গলানো স্বর্ণর প্রলেপ দেওয়া ছিল। এসব কাপড় পোড়ানোর পর সঠিক পরিমাণ স্বর্ণ নিরূপণ করা সম্ভব হবে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় এক কেজি স্বর্ণ তিনি বহন করছিলেন।”
তিনি আরও জানান, আটক ব্যক্তিকে আপাতত সিলেট বিমানবন্দরে রাখা হয়েছে। পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি চলছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, আলীম উদ্দিনের সঙ্গে একই ফ্লাইটে আরেকজন স্বর্ণ পাচারকারী ছিলেন, যাকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটক করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে।
সূত্র জানায়, সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এখন স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। প্রবাসী অধ্যুষিত শহর সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রতিদিনই নামছে বিদেশি ফ্লাইট। সেই ফ্লাইটগুলোতেই আসে স্বর্ণ। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাই, বাহরাইন, সৌদি আরব থেকে আসে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণের চালান। এর মধ্যে বড় চালান আসে দুবাই থেকে।
সূত্র আরও জানায়, নিরাপদে কাস্টম পাড়ি দেওয়া স্বর্ণের এসব চালান চলে যায় রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে। দেশের স্বর্ণের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী বৃহৎ ব্যবসায়ী গ্রুপ এসবের মুল নিয়ন্ত্রক। ফলে মাঝেমধ্যে চালান আটক হলেও হোতারা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ওসমানী বিমানবন্দর সূত্র জানায়, গত ১০ বছরে এই বিমানবন্দর থেকেই জব্দ করা হয়েছে অন্তত ১৭০ কেজি স্বর্ণ। বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা।
অভিযোগ রয়েছে, ওসমানী বিমানবন্দরে একের পর এক স্বর্ণের চালান আটক হলেও এর মূল মালিক বা নেপথ্যের কারিগরদের শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
একাধিক সূত্র থেকে দাবি করা হচ্ছে সিভিল অ্যাভিয়েশনের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় সিলেট রুট ব্যবহার করে চোরাকারবারিরা। প্রায়ই চালান ধরা পড়ার পর পুলিশ স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনায় মামলা দায়ের করার কথা জানিয়ে দাবি করে, চোরাচালানের মূল হোতা শনাক্ত করতে তদন্ত চালানো হবে। কিন্তু পরে সেই তদন্ত কার্যক্রম আর এগোয় না।
সিলেট বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ হাফিজ উদ্দিন বলেন, আমরা সতর্ক আছি বলেই আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্বর্ণের চালান ঢুকতে পারছে না। সমন্বিতভাবে আমরা চেষ্টা করছি। অপরাধীদের বের করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।
সূত্র জানায়, ওসমানী বিমানবন্দরকে ঘিরে একটি শক্তিশালী চোরাচালানি চক্র সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে স্বর্ণের চালান নিয়ে আসছে। এর বাইরে সৌদি আরব থেকেও মাঝে মধ্যে স্বর্ণের ছোট ছোট চালান আসে। তবে, আটক হওয়া চোরাচালানের মধ্যে বেশিরভাগ চালানই দুবাই থেকে নিয়ে আসা হয়। যাত্রীবেশে স্বর্ণের চোরাচালান নিয়ে আসলেও মূলত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে নিয়ে আসা হয়। আর এক্ষেত্রে স্বর্ণ চোরাচালানিদের নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ওসমানী বিমানবন্দরে গত ১০ বছরে (২০১৪ সাল পর্যন্ত) ১৭৩ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়। এর আগে চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি এ দিন ২ যাত্রীর লাগেজ থেকে প্রায় সাড়ে ১৭ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ২১ কোটি টাকা। দুজনকে আটকও করে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও শুল্ক গোয়েন্দা। তারও আগে আরেক বড় চালান আটক করা হয় গত ২৮ আগস্ট। ওইদিন সকালে ওসমানী এয়ারপোর্টে ১৭ কোটি টাকা মূল্যের ১৬ কেজি ওজনের স্বর্ণের চালান জব্দ করা হয়।
এর আগে গত ২৮ আগস্ট সেই একই রুট সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটের (বিজি-২৫২) যাত্রী ছিলেন হোসাইন আহমদ। তার কাছে থাকা লাগেজে তল্লাশি চালিয়ে একটি জুস মেশিনে ১০৫টি স্বর্ণের বারসহ আরও কিছু স্বর্ণ পাওয়া যায়। জব্দকৃত সোনার ওজন ১৫ কেজি ৯১৫ গ্রাম। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ১৭ কোটি টাকা।
এর আগে গত ২০২৩ সালের ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিমানের বিজি-২৪৮ নম্বর ফ্লাইটের চার যাত্রী ও বিমানের টয়লেট থেকে ৩২ কেজি ৬৫ গ্রাম ওজনের ২৮০টি বার ও দেড় কেজি ওজনের ৬টি লিক্যুইড গোল্ড জব্দ করা হয়। ২০২২ সালের জুন মাসে ধরা পড়ে আরো দুটি চালান। দুবাই ফেরত যাত্রী ময়নুল ইসলাম শাকিলের কাছ থেকে ১ কেজি ১৬০ গ্রাম স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। এর আগে ২৭ মে আলী আহমদ নামের আরেক যাত্রীর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় সমপরিমাণ স্বর্ণ।
২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর ৭ কোটি টাকা মূল্যের ১১ কেজি ২২০ গ্রাম স্বর্ণসহ দুবাই ফেরত চার যাত্রীকে আটক করে কাস্টমস। তারা ব্ল্যান্ডার মেশিন ও আয়রন মেশিনের ভেতরে কৌশলে এই স্বর্ণ নিয়ে আসেন। ওই বছরের ৮ নভেম্বর দুবাই ফেরত যাত্রী নরেন্দ্র নাথের কাছ থেকে ৬ কেজি ১৪৮ গ্রাম ওজনের ৩৮ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের দাম প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
২০২০ সালের ১৮ ডিসেম্বর দুবাই থেকে আসা জামিল আহমদ নামের এক যাত্রীর কাছ থেকে ১৪টি স্বর্ণের বার ও কিছু স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের ওজন প্রায় দুই কেজি। যার দাম প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ১২টি বার বিশেষ ব্যবস্থায় জামিলের উরুতে আটকানো ছিল।
২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর আবুধাবী থেকে আসা জাহিদ হোসেন নামের এক যাত্রীর কাছ থেকে ৪ কেজি ৬৪ গ্রাম ওজনের ৪০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া স্বর্ণের দাম প্রায় ২ কোটি টাকা।
একই বছরের ৩ জানুয়ারি একটি ফ্লাইটে তল্লাশি চালিয়ে ৬০ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করে কাস্টমস। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের ওজন প্রায় ৭ কেজি। যার দাম প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ ঘটনায় বাংলাদেশ বিমানের মেকানিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট কারিমুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০১৭ সালের ২৩ জুলাই আবুধাবি থেকে আসা বিমানের লাগেজ হোল্ডে অভিযান চালিয়ে ৩ কেজি ৫০০ গ্রাম ওজনের ৩০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়।
২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর দুবাই থেকে আসা বিমানে তল্লাশি চালিয়ে ১৬টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের ওজন ১ কেজি ৮৭২ গ্রাম। একই বছরের ১৬ নভেম্বর ৯ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের ৮০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে কাস্টমস।
উদ্ধারকৃত স্বর্ণের দাম প্রায় ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিমানের আসনের নিচে তল্লাশি চালিয়ে এসব স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। ওই বছরের ১৭ মার্চ ৫৮০ গ্রাম ওজনের ৫টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। ২৪ এপ্রিল এক লন্ডন প্রবাসীর কাছ থেকে ৪৩২ গ্রাম স্বর্ণ উদ্ধার করে কাস্টমস। ২০১৫ ও ২০১৪ সালে ওসমানী বিমানবন্দর থেকে ১৯ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করে কাস্টমস কতৃপক্ষ।