“রক্ত দিন, আশার আলো জ্বালান – একসাথে জীবন বাঁচাই” এই প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে এবারের বিশ্ব রক্তদাতা দিবস পালিত হচ্ছে। প্রতি বছর ১৪ জুন বিশ্বজুড়ে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস পালন করা হয়। ১৪ জুন দিবসটি পালনের আরও একটি তাৎপর্য রয়েছে। রক্তের গ্রুপ আবিষ্কারক কার্ল লান্ডষ্টাইনারের জন্ম ১৮৬৮ সালের ১৪ জুন। তাই তার জন্মদিনে পালিত হয় বিশ্ব রক্তদাতা দিবস।রক্তের গ্রুপ ‘এ, বি, ও,এবি’ আবিষ্কারের জন্য ল্যান্ডস্টেইনারকে নোবেল পুরষ্কার প্রদান করা হয়।১৯৯৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক রক্তদান দিবস পালন এবং ২০০০ সালে ‘নিরাপদ রক্ত’-এই থিম নিয়ে পালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০৪ সালে প্রথম পালিত হয়েছিল বিশ্ব রক্তদান দিবস। ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য অধিবেশনের পর থেকে প্রতিবছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এই দিবস পালনের জন্য তাগিদ দিয়ে আসছে। প্রতিবছর ৮ কোটি ইউনিট রক্ত স্বেচ্ছায় দান হয়, অথচ এর মাত্র ৩৮ শতাংশ সংগ্রহ হয় উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে, যেখানে বাস করে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ মানুষ। এ ছাড়া এখনো বিশ্বের অনেক দেশে মানুষের রক্তের চাহিদা হলে নির্ভর করতে হয় নিজের পরিবারের সদস্য বা নিজের বন্ধুদের রক্তদানের ওপর, আর অনেক দেশে পেশাদারি রক্তদাতা অর্থের বিনিময়ে রক্ত দান করে আসছে রোগীদের। অথচ বিশ্বের নানা দেশ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে জানা যায়, ‘নিরাপদ রক্ত সরবরাহের’ মূল ভিত্তি হলো স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে দান করা রক্ত। কারণ তাদের রক্ত তুলনামূলকভাবে নিরাপদ এবং এসব রক্তের মধ্য দিয়ে গ্রহীতার মধ্যে জীবনসংশয়ী সংক্রমণ, যেমন এইচআইভি ও হেপাটাইটিস সংক্রমণের আশঙ্কা খুবই কম। স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদানকারী আড়ালে থাকা সেসব মানুষের উদ্দেশ্যে, এসব অজানা বীরের উদ্দেশ্যে, উৎসর্গীকৃত ১৪ জুনের বিশ্ব রক্তদান দিবস। রক্তদান করলে শরীরের কোন ক্ষতি হয় না । এমনিতেই রক্ত কণিকা নির্দিষ্ট সময় পর নষ্ট হয়ে
যায়। আমার মতে,
দিনটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে
১). রক্তদাতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ: যারা স্বেচ্ছায়, নিঃস্বার্থভাবে রক্ত দিয়ে হাজারো মানুষের জীবন বাঁচান।
২) সচেতনতা বৃদ্ধি: সাধারণ মানুষের মধ্যে রক্তদানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানানো।
৩) নতুন দাতাকে উদ্বুদ্ধ করা: যেন সারা বছর রক্তের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে।
৪) নিরাপদ রক্ত নিশ্চিত করা: সংক্রমণমুক্ত, নির্ভরযোগ্য এবং সময়োপযোগী রক্ত প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশে প্রতিবছর ৮-১০ লাখ ইউনিট রক্তের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এর বেশিরভাগই আসে আত্মীয়স্বজন বা প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে দেওয়া রক্ত থেকে।
স্বেচ্ছায় ও নিয়মিত রক্তদানের হার এখনও সন্তোষজনক নয়। এ অবস্থায়-ভ্রান্ত ধারণা (যেমন রক্ত দিলে দুর্বল হয়ে যায়) এখনো অনেকের মধ্যে প্রচলিত।গ্রামাঞ্চলে সচেতনতা কম, যার ফলে সংকট বেশি।রোগীর পরিবারকে হয়রানির শিকার হতে হয় রক্ত জোগাড়ে। এমতাবস্থায়, বিশ্ব রক্তদাতা দিবস বাংলাদেশে পালন করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে একটি সচেতন, মানবিক ও সহানুভূতিশীল সমাজ গড়ে ওঠে।
বাংলাদেশে রক্তদাতার পরিসংখ্যান:
বছরে প্রয়োজন: ৮-১০ লাখ ইউনিট। রক্ত সংগ্রহ হয় ৩০-৩৫% স্বেচ্ছায় দাতাদের থেকে, ৬৫-৭০% আত্মীয়-স্বজন বা পেশাদার দাতার মাধ্যমে নিয়মিত স্বেচ্ছায় রক্তদাতা: আনুমানিক ২.৫-৩ লাখ (প্রধানত তরুণ সমাজ)।
সিলেট অঞ্চলের চিত্র : সিলেট বিভাগে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে স্বেচ্ছায় রক্তদানের হার অনেক কম।তবে এই ক্ষেত্রে অন্যতম সিলেট জেলার অন্যতম উপজেলা জকিগঞ্জ, উল্লেখ্য গত ১২ ই জুন প্রচন্ড দাবদাহের মধ্যেও মানব সেবা ফাউন্ডেশন জকিগঞ্জ আয়োজনে ৮২ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহীত হয়। নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। এভাবে সিলেট অঞ্চলের প্রত্যেকটি উপজেলা পর্যায়ে আমরা রেড ক্রিসেন্ট মুজিব-জাহান রেডরক্রিসেন্ট রক্ত কেন্দ্র, রক্ত সংগ্রহ করতে সদা প্রস্তুত রয়েছে।মুজিব-জাহান রেড ক্রিসেন্ট রক্তকেন্দ্রের রক্ত সংগ্রহের ভ্রাম্যমান শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি রয়েছে।
তাই, এই দিবসে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে মুজিব-জাহান রেড ক্রিসেন্ট রক্ত কেন্দ্র, যা সিলেট অঞ্চলে নিরাপদ রক্ত সরবরাহে নিরলসভাবে কাজ করছে। মুজিব-জাহান রেড ক্রিসেন্ট রক্ত কেন্দ্রের সেবার
পরিসংখ্যান:
সিলেট অঞ্চলের মাসিক চাহিদার প্রায় মুজিব- জাহানেডেক্রিসেন্ট রক্ত কেন্দ্র সরবরাহ করে তার ৪০% রক্ত।
৩৫০ জন নিবন্ধিত থ্যালাসেমিয়া রোগী নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয় এছাড়াও প্রতিমাসে ৬০০+ অন্যান্য রোগীকে নিজস্ব রক্ত পরিসঞ্চাল কেন্দ্রে রক্ত পরিসঞ্চাল করা হয়।
প্রতিদিন ৭০-৮০ জন রক্তদাতা রক্তদান করেন প্রতিমাসে ২৫০০+ জন রক্তগ্রহীতা সেবা প্রদান করা হয়
আধুনিক যন্ত্রপাতি: এফারেসিস মেশিন,সেল সেপারেটর, সিবিসি, ব্লাডনকালেকশন মেশিন, ব্লাড ব্যাংক রেফ্রিজারেটর ইত্যাদি।
উক্ত কেন্দ্রের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা:
এত বড় কর্মযজ্ঞ সত্ত্বেও পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে প্রতিদিন অনেক রক্তগ্রহীতা এবং দাতাকে সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। স্থানের সম্প্রসারণ হলে এই রক্ত কেন্দ্র সিলেটের ৭০-৮০% রক্তচাহিদা পূরণে সক্ষম হবে।এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমার অন্যরকম একটি দরদ কাজ করে, আমি যখন রেড ক্রিসেন্ট এর যুব প্রধান ছিলাম (২০০০ খ্রিষ্টাব্দ) তখন ইটালি রেডক্রস ক্রসের সহায়তায় এই ব্লাড ব্যাংকের প্রতিষ্ঠিত হয়।সিলেটের যুব রেড ক্রিসেন্ট সদস্যরা ছাড়াও, রোটারেক্টর (রোটারি ক্লাব), লিও (লায়ন্স ক্লাব) এবং সিলেটের অসংখ্য সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন সমূহ ও তার সাথে সম্পৃক্ত সদস্যবৃন্দ এই রক্ত কেন্দ্রকে স্বেচ্ছায় রক্তদান করে এই প্রতিষ্ঠানকে গতিশীল রেখেছেন। উল্লেখ্য, সিলেট রেড ক্রিসেন্ট মাতৃমঙ্গল হাসপাতাল ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র এর নিজস্ব জায়গায় ভবন নির্মাণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির অন্যতম সিনিয়র আইনজীবী হিসেবে (যিনি আইন পেশায় ৫০ বছর) সেবা দিয়ে যাচ্ছেন শ্রদ্ধেয় এডভোকেট মুজিবুর রহমান চৌধুরী। এখনো এই প্রতিষ্ঠানকে সদা গতিশীল করতে জনাব মুজিবুর রহমান চৌধুরীর সুযোগ্য পুত্রদ্বয় মেজর (অব:) সারওয়ার জাহান চৌধুরী পাভেল ও সাবেক ব্যাংকার দেলোয়ার জাহান চৌধুরী আপেল উৎসাহিত করেন।এই প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত সকলকে বিশ্ব রক্তদাতা দিবসে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
যেহেতু এখনও সিলেটে রক্তদানের হার প্রয়োজনের তুলনায় কম। সামাজিক আন্দোলন, সচেতনতা ও উদ্দীপনার মাধ্যমে এই চিত্র
পরিবর্তন সম্ভব। আমাদের করণীয়-রক্তবান্ধব সমাজ গঠনে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস উপলক্ষে আমরা যা করতে পারি:
# রক্তদাতা সংবর্ধনা ও সম্মাননা অনুষ্ঠান
# কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তদানের সচেতনতামূলক সেমিনার
# জনসচেতনতা মিছিল, পোস্টার ক্যাম্পেইন
# সামাজিক মাধ্যমে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার প্রচারণা
# ফ্রি ব্লাড গ্রুপিং ও রক্তদাতা রেজিস্ট্রেশন ক্যাম্প
# স্কুল স্তর থেকেই রক্তদানের মানবিক মূল্যবোধ শেখানো।
পরিশেষে রক্তদান শুধু একজনের জীবন বাঁচায় না, সমাজে আশার আলো ছড়িয়ে দেয়। সিলেটবাসীর উচিত এই মানবিক আন্দোলনে যুক্ত হয়ে “স্বেচ্ছায় রক্তদানকে সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করা। মনে রাখবেন “এক ব্যাগ রক্ত মানেই এক জীবনের সম্ভাবনা”-এই উপলব্ধি থেকেই রক্তদানকে সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। আমাদের সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় গড়ে উঠুক এক রক্তবান্ধব, মানবিক বাংলাদেশ।
লেখক: মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম
ট্রেজারার, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি।
সেক্রেটারি জেনারেল, সিলেট ইউনিট।