বিশেষ প্রতিবেদক
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ এখন ‘মাদকের খোলাবাজার’ এ পরিনত হয়েছে। মাদকের ‘সেফ (নিরাপদ) রুট’ হয়ে ওঠেছে এই এলাকা। হাত বাড়ালেই মিলছে সব ধরনের মাদক! প্রকাশ্যে চলছে বেচাকেনা। সন্ধ্যা নামলেই গ্রামের পথে-ঘাটে দেখা মিলছে মাদক ব্যবসায়ী ও সেবীদের। এ অবস্থায় এলাকায় বাড়ছে চুরি-ডাকাতি ও বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ড। বিষয়টি নিয়ে উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভাতেও প্রতিনিয়ত হচ্ছে আলোচনা। সভায় কমিটির সদস্যরা তাদের বক্তব্যে মাদক বিস্তারের ঘটনায় চরম উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। ওইসব সভাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাদকের বিরুদ্ধে জেহাদের ঘোষণা দেয়া হলেও বাস্তব চিত্রে তার ভিন্ন। স্থানীয়রা প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন! এদিকে স্থানীয়রা মাদকসেবীদের আটক করলে নিজেদের ছাত্রদলের নেতা পরিচয়ও দেয়। এসব মাদকসেবীদের আনাগোনা নিয়ে শঙ্কিত এলাকাবাসী! কখন কি ঘটে?
সূত্র জানায়, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাটি ভারতের মেঘালয় রাজ্যঘেঁষা। ফলে চোরাকারবারিরা সহজেই চোরাই পথে ভারতীয় মদ, ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য এ উপজেলায় নিয়ে আসে। মূলত সীমান্তবর্তী উৎমা, তুরং, কালাইরাগ, বরমসিদ্ধিপুর, লামাগ্রাম, মাঝেরগাঁও, কুলিবস্তি, নারাইনপুর প্রভৃতি এলাকা দিয়ে মাদক আনা হয়। পরে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয় উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। পরে হাত বদলে শহরে আনে শহরের মাদক ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, উপজেলার দক্ষিণ রনিখাই ইউনিয়নের খাগাইল, বর্নি, গৌরিনগর, তেলিখাল ইউনিয়নে দলইরগাঁওসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে মাদকের বিস্তার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। গ্রামগুলো সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ মহাসড়ক লাগোয়া। তাই সন্ধ্যা নামলেই মহাসড়কে আনাগোনা বাড়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের। এ কারণে স্থানীয়রা এলাকাটিকে ‘মাদকের খোলাবাজার’ বলছেন। মহাসড়কে দাঁড়িয়ে অভিনব কৌশলে প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে মাদক। পুলিশ মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে দু’একজনকে ধরলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে মূলহোতারা।
নিউজ মিররের অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিদিন বিকেল হওয়ার সাথে সাথে মাদকসেবীরা সিএনজি অটোরিক্সা, মোটরসাইকেল, কার যোগে এসব এলাকায় গিয়ে মাদক সেবন করে এবং মাদক বহন করে শহরে এনে বিক্রি করে। কোম্পানীগঞ্জ রোডে সড়কের পাশে বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত মাদক বিক্রি করে আওয়ামী লীগের ইউপি চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন ইমাদের ভাতিজা পরিচয়দানকারী জিয়া, খাগাইল এলাকার ভিতরে বাজারে বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত মাদক বিক্রি করে পিচ্চি রুবেল, স্কুলের সামনে ফাহিম, লাল ঘরের সামনে আক্তার, তারেক, আজিজ, গোলাপ, আলী, জসিম। তেলিখাল ইউনিয়নে দলইরগাঁওয়ে বাবুল, শহিদ ও কাউছার। বর্নি ব্রিজের পাশে শাহেদ। এসব মাদকব্যবসায়ীরা একাধিকবার প্রশাসনের হাতে আটক হয়েছে, জামিনে বের হয়ে তারা ফের মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পরে।
খাগাইল এলাকার বাসিন্দা মাওলানা সোহেল আহমদ জানান, খাগাইল এলাকায় মাদক ব্যবসা এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। বিষয়টি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এখানে পুলিশের অভিযান তেমন একটা হয়না। মাঝেমধ্যে যারা আটক হয়, জামিনে বের হয়ে তারা ফের মাদকের সঙ্গে জড়ায়।
গোরিনগর গ্রামের বাসিন্দা ও ইউপি সদস্য মাওলানা মাহবুবুর রহমান জানান, শহর থেকে বিভিন্ন বয়সী লোকজন গৌরিনগর এলাকায় গাড়ি থামিয়ে মাদক কিনে নিচ্ছে। বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। এখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা নেই বললেই চলে।
এদিকে, মাদকের বিরুদ্ধে খাগাইল স্টুডেন্ট ফোরাম সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছে। গত বুধবার রাতে তারা লাঠিসোঁটা হাতে রাস্তায় বেরোয় এবং মাদকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেয়। ‘যেই মুখে মা ডাকি, সেই মুখে মাদক না’, ‘জেগেছেরে জেগেছে, ছাত্র সমাজ জেগেছে’, ‘অ্যাকশন অ্যাকশন, ছাত্র সমাজের অ্যাকশন’, মাদকের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশন’-এই মর্মে তারা স্লোগান তারা দেয়।
এ বিষয়ে সংগঠনের সভাপতি মো. লুকেছ আহমদ বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন তিন মাস আগে শুরু হয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে আন্দোলন জোরালো হয়েছে। ফলে পুলিশী তৎপরতা কিছুটা বেড়েছে। মাদক নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।’
অপরদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলার পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নের পাড়ুয়া গ্রামের একজন আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘আমার বড় ভাই নেশায় আসক্ত। নেশার টাকা না পেলে ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর করে ফেলে। একটি পরিবারকে মাদক কীভাবে ধ্বংস করে তা আমার থেকে ভালো আর কেউ জানেন না।’
পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আলমগীর আলম বলেন, ইউনিয়নের কয়েকটি জায়গায় মাদক কারবারিদের দৌরাত্ম্য চোখে পড়ার মতো। রাজনগর নতুনবাজারে নিয়মিত মাদক ও জুয়ার আসর বসে। আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে এ বিষয়ে সব সময় বলি। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তিনি আরও বলেন, গত বুধবার স্থানীয়রা এক মাদকাসক্তকে ধরে পুলিশে খবর দেয়। কিন্তু পুলিশ তাকে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
উত্তর রনিখাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাস্টার ফয়জুর রহমান বলেন, ‘সীমান্ত দিয়ে গভীর রাতে মাদকের চালান ঢুকছে। প্রবেশপথগুলোতে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। বিজিবির পাশাপাশি পুলিশী তৎপরতা বাড়ানো দরকার। এছাড়া মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জেল-জরিমানা করা গেলে ফলপ্রসূ হতো।’
কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের আল মাহমুদ আদনান বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করছে পুলিশ। মাদকসেবীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। গত বুধবার খাগাইল থেকে বাবুল মিয়া নামে একজনকে আটক করা হয়েছে। মাদক নির্মূলে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। মাদক সংশ্লিষ্ট কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এজন্য স্থানীয়দের সহযোগিতা প্রয়োজন।