বিশেষ প্রতিবেদক
সিলেটের হরিপুরের চোরাকারবারিরা নিজেদের দাপট জাহির করতে গিয়ে সমস্যা প্রকট করেছে। তারা সেনাবাহিনীর ওপর হামলা করেছে। তাদের হামলায় এক কর্মকর্তাসহ কয়েকজন সেনাসদস্য গুরুতর আহত হয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে ভাবছে সিলেটের প্রশাসনও। কী করা যায় হরিপুরকে নিয়ে।
ঘটনার পর থেকে সেনা সদস্যরা অভিযানে রয়েছেন হরিপুরে। বাজার নিকটবর্তী গ্রামগুলোর ঘরে ঘরে চলছে তল্লাশি। এই অবস্থায় হরিপুর বাজারও নীরব হয়ে পড়েছে। বলতে গেলো পুরুষ শূন্য বাজার ও আশপাশের কয়েকটি গ্রাম।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে বাজারে কেবলমাত্র নিত্যপণ্যের ক্রেতা-বিক্রেতা ছাড়া আর কাউকে দেখা দেখা যায়নি। বাজারের বেশির ভাগ দোকানপাট ছিল বন্ধ। জৈন্তাপুর উপজেলার আলেম-উলামা শাসিত একটি অঞ্চল হচ্ছে হরিপুর। সেটি পূর্ব সিলেটের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্রও। গত দুই যুগ ধরে আলেম উলামা শাসিত হরিপুর নতুন নামে পরিচিতি পেয়েছে। সেটি হচ্ছে চোরাই রাজ্য হরিপুর।
প্রথমে হরিপুরে চোরাই গরু মহিষের হাট বসতো। এখনো সেটি বসে। তবে চোরাই পশুর হাটের নাম ছাপিয়ে এখন চোরাই চিনির রাজ্যে পরিণত হয়েছে এ বাজার। সীমান্ত দিয়ে সব ধরনের পণ্য আসে হরিপুরে। ওখান থেকে গাড়িযোগে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এ কারণে হরিপুরকে বলা হয় চোরাই সিন্ডিকেটের হেডকোয়ার্টার।
এলাকার কয়েকটি গ্রামের লোকজন ঘরে ঘরে চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। ঘটনা গত বুধবার রাতের। গাছবাড়ি এলাকার জসিম নামের এক চোরাকারবারির মহিষের চালান ট্রাকযোগে হরিপুর বাজারে নিয়ে আসা হচ্ছিল। হরিপুর বাজারে পৌঁছামাত্র চোরাই পশু বহনকারী ওই ট্রাকচালক টহলে থাকা সেনাবাহিনীর একটি পিকআপকে চাপা দিয়ে চলে যেতে চাইছিল।
উপস্থিত থাকা লোকজন জানিয়েছেন- টহলে থাকা সেনাসদস্যরা গরু বাজার এলাকায় গিয়ে ওই ট্রাক ও চালককে আটক করেন। বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে ট্রাকচালককে আটক করে জানতে চান কি কারণে এতো বেপরোয়া। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন হরিপুরের চোরাকারবারিরা। তারা নিজেদের দাপট দেখাতে গিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যদের উপর হামলা করে বসে। এ সময় উপস্থিত কয়েক শ’ মানুষ সেনাবাহিনীর গাড়ি লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ছুড়ে। একপর্যায়ে তারা লাঠিসোঁটা নিয়ে মহড়া দিয়ে পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তোলে। ওই সময় ঘটনাস্থলে এক সেনা কর্মকর্তা ছাড়া কয়েকজন সদস্য গুরুতর আহত হন।
ঘটনার পর সেনাবাহিনীর অন্য সদস্যরা গিয়ে হরিপুর থেকে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। এ ঘটনার পর সেনাবাহিনীর কয়েকটি টিম হরিপুর যায়। তারা সিলেট-তামাবিল সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে। রাত ১২টা থেকে শুরু করে সাঁড়াশি অভিযান। তবে ঘটনার গভীরতা আঁচ করতে পেরে রাত ১১টা থেকে বাজারে বড় ধরনের সেনা অভিযানের আশঙ্কা করেন ব্যবসায়ীরা।
এজন্য বাজারের প্রায় সব ব্যবসায়ী দোকানপাট বন্ধ করে বাড়িতে চলে যান। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- এই মহিষের চালানের গন্তব্যস্থল ছিল হরিপুর বাজারে। গাড়িটি হরিপুর বাজারে এসে সেনাবাহিনীর সদস্যদের দেখে ভড়কে যাওয়া ট্রাকচালক দ্রুত হাটে ঢুকতে গিয়ে এ বিপত্তি ডেকে এনেছে। নতুবা সে সেনাবাহিনীর গাড়িকে চাপা দেয়ার প্রয়োজন হতো না।
এ সময় বাজারের অন্যতম নিয়ন্ত্রক সভাপতি হেলাল ও সাবেক সভাপতি আব্দুল্লাহ সহ কয়েকজন ব্যবসায়ীও সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের সময় আহত হন। তারা বর্তমানে অজ্ঞাতস্থানে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর মধ্যে হেলাল ও আব্দুল্লাহর অবস্থা গুরুতর বলে জানান তারা।
এদিকে রাতের ঘটনার পর থেকে অভিযানে রয়েছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। রাত দুইটার দিকে ইউনিয়ন কার্যালয়ে ডেকে পাঠানো হয় বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন সহ কয়েকজন ইউপি সদস্যদের। রাতে অভিযানে থাকা সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ইউনিয়ন অফিসে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এ সময় তাদের দিয়ে কয়েকজন চিহিৃত চোরাকারবারিকে ডেকে আনার চেষ্টা করলেও তারা আসেননি। এর মধ্যে ছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা আব্দুর রশিদ, হাজী হেলাল।
তথ্য সংগ্রহ করে পুলিশ হরিপুর বাজারের নিকটবর্তী হরিপুর, চানপুর, হেমু, হাউদপাড়া, বালিপাড়া সহ কয়েকটি গ্রামে ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে সেনাবাহিনীর সদস্যরা গিয়ে চোরাচালানের গডফাদার আব্দুর রশিদ চেয়ারম্যানের বাড়ি হানা দেয়। এ সময় তারা ঘর তল্লাশি করলেও রশিদ চেয়ারম্যানের খোঁজ পায়নি।
অভিযানের সময় সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে বাজার থেকে ব্যবসায়ী আশফাক সিকদার, তার ভাই হানিফ শিকদার, ড্রাইভার কামরুল সহ আরও কয়েকজন ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়।
এদিকে ঘটনার খবর পেয়ে বুধবার রাতে হরিপুরে এসেছিলেন জৈন্তাপুর থানার ওসি বদরুজ্জামান বাদল। তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে জানিয়েছেন- ঘটনার খবর পেয়ে তিনি হরিপুরে গিয়েছিলেন। ওখানে সেনাসদস্যরা ছিলেন। তবে এ ঘটনায় আটক হওয়া কাউকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়নি। তিনি জানান, কোনো মামলাও হয়নি। ঘটনা, আটক সম্পর্কে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সেনাবাহিনীর তরফ থেকে কোনো ব্রিফ করা হয়নি।
বিজিবিতে কর্মরত এক সেনা কর্মকর্তা জানিয়েছেন- হরিপুরের চোরাকারবারিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। টহলে থাকা সেনাবাহিনীর গাড়িকে চাপা দিয়ে এ ঘটনার সূত্রপাত ঘটানো হয়েছে। এরপর সেনাসদস্যদের উপর হামলা করা হয়েছে। এমন ঘটনা কোনো আইনই গ্রহণ করে না। ফলে চোরাকারবারিদের রুখতে এই মুহূর্তে সাঁড়াশি অভিযান ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলে দাবি করেন তিনি।