নিজস্ব প্রতিবেদক
সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিমেবি) চৌহাট্টাস্থ উপাচার্যের অস্থায়ী কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করছে কতৃপক্ষ। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চলমান আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে কতৃপক্ষ নির্লজ্জ মিথ্যাচার করছে বলে অভিযোগ করছেন আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারী।
তাদের দাবি, দুই বছরের বেশি সময় ধরে তারা বিনা ভেতন-ভাতায় কাজ করে যাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. এনায়েত হোসেন আশ্বাস দিয়ে তাদের দুবছর কাজ করিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে তারা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। তবে কোনো সুরাহা হয়নি। এমতাবস্থায় চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন ভিসি এনায়েত হোসেন। একই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভিসি হিসেবে যোগ দেন অধ্যাপক ডা. ইসমাইল হোসেন পাটোয়ারি। তিনি যোগদানের পর গত ১৬ মার্চ উপাচার্যের কাছে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেন ১১তম সিন্ডিকেটে গঠিত নিয়োগ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম। এরপর ২৩ মার্চ উপাচার্য ১২তম সিন্ডিকেট ডাকেন। এ সিন্ডিকেটের পর থেকে উপাচার্য চৌহাট্টাস্থ কার্যালয়ে অফিস করেননি।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি, আগামী ১ সপ্তাহের মধ্যে সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১তম সিন্ডিকেটে গঠিত কমিটির সুপারিশের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ছাড়া উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে উপাচার্যকে বিদ্যমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে আলোচনা করে সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করতে। অন্যথায় দাবি আদায়ে তারা আরো কঠোর কর্মসূচী পালনের হুশিয়ারি দেন।
এর আগে গত শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে উপাচার্যকে ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দেন বেতন-ভাতাবঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য গত বুধবার সকাল সাড়ে ১০টায় সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সম্মেলন কক্ষে ‘সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রেক্ষাপেট ও ভবিষ্যত করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভা ডাকেন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. ঈসমাইল হোসেন পাটোয়ারী।
মতবিনিময় সভায় উপাচার্য বলেন, আমি যোগদান করে ইনভেনটরি করেছি। অনেক নথিপত্র গায়েব করে দেয়া হয়েছে, আপনারা জানেন, কারা এই লুটপাট, হামলা ও ভাংচুর করেছে, ইতোমধ্যে পত্রপত্রিকায় তাদের নাম এসেছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রায় কেউ বাধাঁ সৃষ্টি করলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। এজন্য সিলেটবাসীর সহযোগিতা প্রয়োজন। আপনারা জানেন, কারা এসব করছে, এরা ৫ আগস্টের পূর্বে ফ্যাসিবাদের সমর্থক ছিল, অনৈতিক উপায়ে চাকরি নিয়েছে, এখন আবার বৈষম্যবিরোধী সেজে আন্দোলন করছে। এরাই বিশৃংখলা সৃষ্টি করছে, অত্রএব বিশৃংখলা সৃষ্টি করলে এখন আর কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের দিন বিকেল ৩-৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহাট্টাস্থ উপাচার্যের কার্যালয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। শতাধিক বিক্ষুব্ধ জনতা একটি মিছিল থেকে এসব ভাঙচুর চালানো হয়েছে। ভাঙচুরের বেশ কয়েকটি ভিডিও প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
এদিকে, কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই উপাচার্যের এমন মনগড়া মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারা বলছেন উপাচার্য যোগ দিয়েছেন দুমাসও হয়নি। তিনি কোনো তদন্ত ছাড়াই আমাদের দোষারপ করছেন। আমাদের আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করতে ফ্যসিবাদের তকমা দিচ্ছেন। অথচ আমারাই আন্দোলন করে আগের ফ্যাসিস্ট উপাচার্য এবং রেজিস্ট্রারকে সরিয়েছি। তিনিই তো আমাদের আন্দোলনের ফলস।
অভিযোগ করে তারা বলেন, উপাচার্য দুদকের চার্জশিটভুক্ত আসামিদের নিয়ে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে অফিসিয়াল কার্যক্রম চালাচ্ছেন। ফ্যাসিবাদের অনুসারীদের নিয়ে অফিস করছেন। তখন সমস্যা হচ্ছে না। আর আমরা যখন আমাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে সোচ্চার তখন আমাদেরকে ফ্যসিবাদের তকমা দিচ্ছেন। মূলত আগের ভিসি সকল অপকর্ম ঢাকতে এবং দুর্নীতিবাজদের বাচাতে তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। আমারা যাতে আন্দোলন থেকে সরে যাই সেজন্য আমাদেরকে নানা ধরণের ট্যাগ দিচ্ছেন।
সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ শাহ আলম জানান, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত তিনজন উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হলেও গত কয়েক বছরে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে উপাচার্য অধ্যাপক ইসমাইল পাটওয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে কাজ করতে না পেরে ওসমানী মেডিকেল কলেজের একটি কক্ষে অফিস করছেন।
কোষাধ্যক্ষ জানান, প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোর্শেদ আহম্মেদ চৌধুরী সিন্ডিকেটের অনুমোদন ছাড়াই চারবার অবৈধভাবে এডহক ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্তদের চাকরির মেয়াদ বাড়িয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যেখানে ১১২টি পদ অনুমোদন করেছে, সেখানে প্রায় ২৫০ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫৮ জনের নিয়োগে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে।
তিনি আরও জানান, মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির যৌথ তদন্তে দেখা গেছে, ‘সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১৮’ এর ১২(১০) ধারা অনুযায়ী, বিধি বহির্ভূতভাবে নিয়োগ পাওয়া ২৪০ জনের অধিক কর্মচারীর চাকরি বাতিল এবং তাদের বেতন-ভাতা ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে স্থগিত করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আন্দোলনে নামেন ওই নিয়োগপ্রাপ্তরা।
২০২২ সাল থেকেই তারা বিভিন্নভাবে আন্দোলন শুরু করেন এবং ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে অবস্থান নেন। এ সময় ক্যাম্পাসে ভাঙচুর, তালা ভেঙে কক্ষের আলমিরা ও ফাইল কেবিনেট থেকে জরুরি কাগজপত্র, ব্যাংকের চেক বহি ও গুরুত্বপূর্ণ নথি লুট করার ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসন এ বিষয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। পরবর্তীতে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালানো সম্ভব না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম স্থানান্তর করে ওসমানী মেডিকেল কলেজে চালানো হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয়তাবাদী কর্মচারী পরিষদের সভাপতি আব্দুস সামাদ চৌধুরী বলেন, উপাচার্য নির্লজ্জ মিথ্যাচার করছেন। আমাদের চলমান আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নানা ফন্দি আঁটছেন। তিনি দ্বায়িত্বশীল যায়গা থেকে খামখা আমাদের দোষারপ করছেন। ৫ আগস্ট হওয়া ভাঙচুর ও লুটপাটের দায় আমাদের উপর চাপানোর চেষ্টা করছেন।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে লুটপাটের ঘটনায় তৎকালীন প্রশাসন ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট নগরের কোতোয়ালী মডেল থানায় একটি জিডি করে। জিডি নং ৩৬২ (১৩/০৮/২৪)। পরবর্তীতে ১৭ আগস্ট একই থানায় আরেকটি জিডি করা হয়। জিডি নং ৫৬৪ (১৭/৮/২৪)। জিডিতে বলা হয়েছে গত বছরের ৫ আগস্ট সন্ধ্যার পর অজ্ঞাতনামা কয়েকজন ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে গুরুত্বপূর্ণ নথি, চেক বহি ও বিভিন্ন কাগজপত্র লুট করে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তারা দুটি গাড়ি ভাঙচুর করে। সেই ভাঙচুরের ভিডিও আমরা পরবর্তীতে সংরক্ষণ করেছি। তবু শুধমাত্র আন্দোলন থামাতে এ সবকিছুর দায় আমাদের উপর চাপানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। জিডিতে কারো নামউল্লেখ করা না হলেও এতে আমাদের জড়াতে প্রশাসনের উপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাদেরকে ফাঁসানোর পায়তারা করা হচ্ছে।
এ বিষয় জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. ঈসমাইল হোসেন পাটোয়ারীর মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেন নি।