স্পোর্টস ডেস্ক
পৃথিবীর যে প্রান্তেই খেলতে গেছেন মঈন আলি, তাকে ঘিরে বাড়তি একটা কৌতূহল কাজ করেছে সবার মাঝে। আর সেটি হলো মূলত তার লম্বা দাড়ি রাখার কারণেই। একজন প্র্যাকটিসিং মুসলমান ক্রিকেটার মঈন। ঠিকমতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। রমজানে রোজা রাখেন। ইসলামের নিয়মকানুন সঠিকভাবে মেনে চলার চেষ্টা করেন।
ইসলামিক জীবনধারার মধ্যে থেকেই ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলেছেন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মঈন। ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ জয়ের পেছনে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার বেশ সমৃদ্ধ। তিন ফরম্যাট মিলে ইংল্যান্ডের হয়ে ২৯৮টি ম্যাচ খেলেছেন। নাসের হোসেনের পর এশিয়ান বংশোদ্ভূত কোনো ক্রিকেটার হিসেবে ইংল্যান্ড দলকে নেতৃত্বও দেন মঈন।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরে রয়েছেন এই অলরাউন্ডার। তবে মঈন যতদিন খেলেছেন, তার দাড়ি নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন। তার দাড়িকে ভিক্টোরিয়ান যুগের ক্রিকেট কিংবদন্তি ডব্লিউজি গ্রেসের মতো মনে করা হয়। মঈনের দাড়ি রহস্যটা আসলে কী!
তখন তার বয়স ১৮। দাড়ি ছিল না।
ইংল্যান্ডের মতো দেশে ইউরোপিয়ান কালচারে অন্য ছেলেদের মতো মঈনও বেড়ে ওঠেন। বেপরোয়া জীবন ছিল তার। কোনো সময় চিন্তায়ও আসেনি ইংল্যান্ডের হয়ে খেলবেন আর মুখভর্তি দাড়ি থাকবে তার। তবে টিনেজার মঈনের ধর্মের প্রতি বেশ ঝোঁক ছিল। ধর্ম নিয়ে গভীর চিন্তা করতেন। ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতেন। তার মনে প্রশ্ন জাগে- কেন মানুষ ধর্ম পালন করে!
একদিনের ঘটনা। একটি ম্যাচ খেলছিলেন মঈন। সেখানে খ্রিষ্টীয় ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণকারী একজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তার। কৌতূহলবশত জানতে চাইলেন কেন মুসলিম হলেন। এই ধর্মে তো বিয়ে বাধ্যতামূলক আর অনেক কিছুই মনে হচ্ছে সঠিক নয়? ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী বললেন, ‘এটি ভুল ভাবনা। ধর্ম নয়, কালচারের কারণে ভুল কিছু জিনিস চালু হয়ে গেছে।’ এক কথা- দুই কথা বলার পর থেকে ইসলাম ধর্ম চর্চা শুরু মঈনের। লম্বা দাঁড়ি রাখেন, নামাজ পড়া শুরু করেন। ইংল্যান্ডে জুলাই মাসে ১৯ ঘণ্টা রোজা। আর রোজা রেখে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেট খেলা তো আরো কঠিন। তবে এ অবস্থায় রমজান মাসে ৩০টি রোজাই রাখেন মঈন। কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক জীবনবিধান অনুসরণ করেন এই ক্রিকেটার। সব মিলিয়ে মঈন পরিণত হলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে।
সেই ১৮ বছর বয়স থেকে দাড়ি রাখা মঈন ইংলিশ মিডিয়ার নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন। তার দাড়িকে তালেবান দাড়িসহ নানা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তবে কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করেননি মঈন। শুরুতে দাড়ি রাখতে গিয়ে কিছুটা ভয়ে ভয়েই থাকতেন। কেননা, দাড়িওয়ালাদের সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দেওয়া হতো। অবশ্য সময়ের পরিক্রমায় সেই ভয় কেটে গেছে তার। কোনো কিছুতেই পরোয়া করেন না। ইসলাম ধর্মচর্চার কারণে অনেক সময় পশ্চিমা মিডিয়ার খবরের শিরোনাম হয়েছেন এই ক্রিকেটার।
২০১৪ সালে ২৮ জুলাইয়ের একটি ঘটনা। সাউদাম্পটনে ভারতের বিপক্ষে তৃতীয় টেস্টে দ্বিতীয় দিন। বাম হাতে ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’, ‘সেভ গাজা’ দুটি রিস্টব্যান্ড পরে খেলতে নামেন মঈন। তখন ইসরাইলি আগ্রাসনে ১০০-এর বেশি মানুষ মারা যায়। হাজার মানুষ গৃহহীন হয়। ইংলিশ গণমাধ্যম মঈনের বিরুদ্ধে নিউজ করে। বলা হয়, রাজনৈতিক, ধর্মীয় কিংবা বর্ণবাদীর সঙ্গে সম্পৃক্ত এরকম বার্তা আইসিসির আইনের পরিপন্থি। তবে শক্তভাবে ফিলিস্তিনের পক্ষ নেন মঈন। অবশ্য এ ব্যাপারে পরে ইংলিশ ক্রিকেট বোর্ডকে পাশে পান এই মুসলিম ক্রিকেটার। উম্মাহ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের জন্য ফান্ড সংগ্রহ কাজেও অংশ নেন তিনি।
ইংল্যান্ড যখন বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের পর মাঠে শ্যাম্পেইন ছিটিয়ে উদযাপন করে, তখন আলাদা হয়ে যান মঈন। ধর্মীয় অনুশাসন মানতেই এমনটা করেন এই ইংলিশ খেলোয়াড়। শুধু তা-ই নয়, জার্সিতে কোনো অ্যালকোহলের বিজ্ঞাপনের লোগোও ব্যবহার করেন না। ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে সতীর্থ থেকে শুরু করে সবার সাপোর্ট পেয়েছেন মঈন। কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাব ওয়ারউইকশায়ার তো নামাজের জন্য আলাদা একটি রুমের ব্যবস্থাই করে দেয়।
যাইহোক, পশ্চিমা জীবনধারার বিপরীত স্রোতে লড়ে একজন অন্তঃপ্রাণ মুসলমান হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেন মঈন। তিন বছর আগে এক গণমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে এই ক্রিকেটার বলেছিলেন, ইসলামই আমার কাছে সবকিছু এবং সবার আগে। আমার এবং আমার পরিবারের কাছে ইসলাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মঈন আলির কাছে ধর্ম বিশেষ অর্থবহ।
এই ক্রিকেটার আরো বলেন, ‘ধর্মকে আমরা দৈনন্দিন বিষয় হিসেবে গুরুত্ব দিই। ক্রিকেটে যেমন ক্রিকেটাররা রোল মডেল, ঠিক তেমনি ধর্মের মধ্যে নবী-রাসুলরা রোল মডেল।’ যথাসম্ভব দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও রমজানে রোজা পালনের চেষ্টায় ত্রুটি করেন না মঈন। ব্যক্তিগত জীবনে এক মেয়ে ও এক ছেলে সন্তানের বাবা এই খেলোয়াড়। তার স্ত্রী ফিরোজা হোসেনের ইচ্ছা ছেলেকে ভবিষ্যতে বড় আলেম হিসেবে গড়ে তুলবেন।